বুধবার, ০৬ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:১৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
টুঙ্গিপাড়ায় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের থানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত পেকুয়া শহীদ ওয়াসিমের স্মরণে স্মৃতি ফলক উন্মোচন ও বৃক্ষ রোপণ  জুড়ীতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উদযাপন  ত্রিশালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে খেলা ও পুরস্কার বিতরণ জুলাই শহিদ পরিবার,আহত ও সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নিয়ে সম্মেলন ও দোয়া মাহফিল শ্রীপুরে গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বিএনপির বিজয় র‍্যালীতে জনতার ঢল  ট্রাম্পকে গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে চিঠি ইসরায়েলি অবসরপ্রাপ্ত ৬শ’ কর্মকর্তার গণঅভ্যুত্থান দিবসে স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করলেন প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জুলাই ঘোষণাপত্র: তাহেরের নেতৃত্বে অংশ নেবে জামায়াতের প্রতিনিধিদল

১৫ জুলাই: কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা, রণক্ষেত্র ঢাবি

বাসস
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫
  • ২৬ Time View

ছবি: তথ্য মন্ত্রণালয়

বাসস:

২০২৪ সালের ১৫ জুলাই (সোমবার) সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগের ওই হামলায় সারাদেশে চার শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আহত হন ২৯৭ জন শিক্ষার্থী। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এদিন হাসপাতালে গিয়েও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

আগের দিন ১৪ জুলাই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করেন। এ কটূক্তির প্রতিবাদে রাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রাত ১১টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হলসহ প্রায় প্রতিটি আবাসিক হল থেকে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন শত শত শিক্ষার্থী।

পরের দিন ১৫ জুলাই ধানমন্ডিতে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তার আত্মস্বীকৃত রাজাকার, গত রাতে নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এর জবাব ছাত্রলীগই দেবে।’ সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়েছে, তাদের শেষ দেখে ছাড়বেন বলে হুমকি দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। এই দুইজনের এমন বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর স্বশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

১৫ জুলাই দুপুর ১২টার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত সাত কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়ার দিকে মিছিল নিয়ে যান। সেখানে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। বিজয় একাত্তর হলের সামনে সংঘর্ষের সূচনা হয়। তখন আশপাশের হল ও মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এসে মল চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে।

ছাত্রলীগের হামলার মুখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ভিসি চত্বর এলাকায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রড, হকিস্টিক, রামদাসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের ভেতর আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও তাদের মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়।  ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক চলে যান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ, মহানগর শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মহড়া দেয়। এ হামলায় অনেক নারী শিক্ষার্থীসহ প্রায় তিনশ’ শিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নেন। বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন।

এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটেও আহত শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েক দফা হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করা হয়েছে। আহতদের মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। ককটেল নিক্ষেপ করেছে। পুলিশ কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। আমাদের ওপর এ হামলা পরিকল্পিত। এ হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

ক্যাম্পাসের সহিংসতার ঘটনায় করণীয় ঠিক করতে এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের প্রাধ্যক্ষদের নিয়ে বেঠক করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। বৈঠক শেষে উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের প্রাধ্যক্ষরা রাতভর হলে অবস্থান করবেন।’ সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয় পুলিশ। সন্ধ্যার পরপরই ক্যাম্পাসে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ১৫ জুলাই রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মোবাইল তল্লাশি ও মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। স্যার এ এফ রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল ও শহীদ সার্জেন্ট জহরুল হক হলে এমন ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন যুক্ত কি না, তা যাচাই করতে শিক্ষার্থীদের  মোবাইল তল্লাশি করা হয়। আন্দোলনে সম্পৃক্ততা পেলেই মারধর করা হয়।

এদিন রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা ও মারধর করে কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা। শিক্ষার্থীরা যাতে আন্দোলনে যেতে না পারে, সেজন্য কলেজের গেটে তালা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের একটি অংশ তালা ভেঙে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যান।  কোটা আন্দোলনকারীদের নিয়ে শেখ হাসিনার কটূক্তির প্রতিবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধা অতিক্রম করে পুরান ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে এসে বিক্ষোভে যোগ দেন। এর আগে জবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও কোটা আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ মিছিলে দফায় দফায় হামলা করে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুসহ ১৫ জন আহত হন। এর আগে ১৪ জুলাই মধ্যরাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। রাত সাড়ে ১২টার দিকে শতাধিক বহিরাগত নিয়ে এ হামলা চালানো হয়। এতে অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হন। পরে তারা ভিসির বাসভবনে আশ্রয় নেন।

১৫ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দুই দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও কাটাপাহাড় সড়কে আন্দোলনকারীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরেও কোটাবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এতে সাংবাদিক ও পুলিশসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।

এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। যশোরে এম এম কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ। দুপুরে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কাছাকাছি পৌঁছালে ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা চালায়। এদিন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বরাবর স্মারকলিপি দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর নতুন বাজার, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এদিন দুপুর থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এছাড়া রাজধানীর বাইরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।
১৫ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দেওয়াকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।’

তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘রাজাকারের পক্ষে স্লোগান রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান। এটি সরকারবিরোধী নয়, এটি রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান।’ এদিকে কোটা আন্দোলনে যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে, তাদেরকে ‘এ যুগের রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।  তিনি বলেন, ‘এ যুগের রাজাকারদের পরিণতি, ওই যুগের রাজাকারদের মতোই হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) বিকেল ৩টায় দেশব্যাপী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল এবং এই আন্দোলনে দেশের সাধারণ মানুষকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এবং নিন্দা জানাই। তার এমন বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে।’

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category